কৃষিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কী?
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকার ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তি ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন- কৃষি ভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটির অধিক এবং এটি বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ এবং সে সাথে একটি সম্ভাবনাময় বড় বাজার। অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনাময় বাজারের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও বাংলাদেশের প্রবেশের বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসেবে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি বাজারে প্রবেশের বড় সম্ভাবনাও আছে। কৃষি এখনো দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠির প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন জীবিকা ও কর্মসংস্থান এর জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল, কাজেই কৃষিভিক্তিক শিল্পে স্বল্পমাত্রার সঞ্চালনা ও প্রেষণাই আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে এবং গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন তথা দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষিশিল্পের উন্নয়ন এবং এ সেক্টরকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার জন্য কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার অর্জন করেছে। তবে ২০০৮ সাল থেকে বাজেটে কৃষি সেক্টরের বরাদ্দ তেমন বাড়েনি, বরং মোট বাজেটে তা শতকরা হারে ক্রমাগত কমছে। জাতীয় বাজেটে মোট ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু কৃষিখাতে তা প্রতিবছর ক্রমাগতভাবে কমছে।
বৃহৎ অর্থে কৃষিতে শস্য, প্রাণিসম্পদ (গবাদিপশু, মৎস্য ও পোল্ট্রি) এবং বন খাত অর্ন্তভুক্ত। শস্যের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, গম, শাক-সবজি, আখ, ডাল ফসল ইত্যাদি। প্রাণিসম্পদের মধ্যে অর্ন্তভূক্ত গবাদিপশু, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, হাঁস-মুরগী ও মৎস্য। আমাদের জিডিপিতে কৃষির বর্তমান অবদান ১৮.৪০ ভাগ (২০১১-২০১২ অর্থ বছরের)। কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় উপ-খাত হল ফসল যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৭২ ভাগ জোগান দেয়। মৎস্য, পশুসম্পদ এবং বন উপ-খাতের অংশ যথাক্রমে শতকরা ১০.৩৩, ১০.১১ এবং ১০.০০ ভাগ।
একটি কৃষিভিক্তিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ফসল এবং ফল-মূল উৎপাদিত হয়। অধিকন্তু পোল্ট্রি, ডেইরী, মৎস্য ইত্যাদি উপ-খাত হিসেবে সাম্প্রতিক কালে উদীয়মান এ সকল কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে রপ্তানিরও অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি ভিত্তিক শিল্পের মধ্যে রয়েছে পোল্ট্রি ফার্ম, ডেইরী ফার্ম, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, মৎস্য হিমায়িতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। দেশের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী। জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রকল্প এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদেরকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষি জমি খন্ড-বিখন্ডিত এবং তা সাধারণত ছোট, যা সমবায় পদ্ধতিতে আবাদ করে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার জনপ্রিয়তার লাভ করছে। এর মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। বাংলাদেশের ধান, পাট, আখ, আলু, ডাল ফসল, গম, চা, তামাক, তৈলবীজ প্রধান ফসল। আমাদের কৃষি সেক্টরে ফসল উপ-খাতই শক্তিশালী যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৭০ ভাগ যোগান দিচ্ছে।
জাতির খাদ্য চাহিদার যোগান দেয়াই সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, সিডর, আইলা ইত্যাদির ফলে খাদ্য এবং অর্থকরী ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারও নানান কর্মসূচী – যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ। এসব কর্মসূচীর মধ্যে আরো রয়েছে উন্নত জাতের ফসলের জাত, বীজ ব্যবহার এবং বালাই দমন ইত্যাদি।
যদিও ধান এবং পাট আমাদের প্রাথমিক ফসল তবে গম, ভূট্টা এবং শাক-সবজি ইত্যাদিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে গম চাষীরা ভূট্টা উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ভূট্টা মূলত: মাছ এবং পোল্ট্রি ফিড প্রস্তুতে ব্যবহার হয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চালে চা এর আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের উর্বর মাটি ও পর্যাপ্ত পানি থাকার কারণে অনেক এলাকাতেই ধানের আবাদ হচেছ বৎসরে তিন বার।
বাংলাদেশের গৌণ ফসল যেমন- ডাল, মসলা, ইক্ষু, ফল-মূল, শাক-সবজি এবং তামাক এর উৎপাদন আগেকার মতই থেকে যাবে বলে ধারণা করা যায়। এ সকল গৌণ ফসলের অবদান আমাদের ফসল উপ-খাতে প্রায় ৩০ ভাগ। গবাদি পশুর উৎপাদন বৃদ্ধি হতে পারে প্রায় ৩.৪৬ ভাগ, যা পূর্বেকার বছরগুলোতে ছিল ২.৪৪ ভাগ।
শস্য উপ-খাত
বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের রয়েছে উজ্জল সম্ভাবনা, যেহেতু দেশটি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যশস্য, ফল-মূল ও শাক-সবজি উৎপাদন করছে এবং এর মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখে চলছে। আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, সীম, বিভিন্নজাতের লাউ-কুমড়া, পালনশাক, মটরশুঁটি ইত্যাদিও উৎপাদিত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। এর পাশপাশি ব্রকলি, গাজর, সেলারি, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরী ইত্যাদির উৎপাদনও হচ্ছে। কিন্তু কৃষি ব্যবসা জোরদারকরণে উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, প্রাকৃতিক গ্যাসের সহজলভ্যতা ছাড়া ক্ষুদ্র, মাঝারী এবং বৃহৎ কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কৃষিজাত পণ্য বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয় দেশসমূহে রপ্তানি করতে হলে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে করে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এর ফলে কৃষকরাও কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের আয় এবং জীবনমান উন্নয়নে অনুপ্রাণিত হবে।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাত উপ-খাত
বাংলাদেশের শিল্পখাতের মধ্যে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প অন্যতম প্রধান এবং সম্ভাবনাময় খাত। যা কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজন ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারছে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প দেশের প্রস্তুতকৃত খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ২২ ভাগের চাইতেও বেশী এবং এই উপখাত ২০ ভাগ শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান করছে। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি) সকল খাদ্য প্রক্রিয়াজাত এন্টারপ্রাইজ এর অবদান ২ ভাগ। দেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প প্রকৃতিগত ভাবেই আকার, প্রযুক্তি, পণ্যের গুণগতমান, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বিপণন এবং বন্টনের ভিত্তিতে বহুমূখী। এই খাতে প্রাথমিকভবে মূলত: ক্ষুদ্র এবং মাঝারী শিল্পই বেশী এবং স্থানীয় উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণের সম্ভাবনা, মূল্য সংযোজন এবং রপ্তানীর সাথে সংযুক্ত। দেশে প্রায় ৭০০ প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য প্রস্তুতকারী শিল্প রয়েছে, যার মধ্যে গৃহে প্রস্তুতকৃত পণ্যও আছে এবং এর মধ্যে অন্তত ৩০ টি শিল্প কারখানা। যার মধ্যে রয়েছে কনফেকশনারী, ফল-মূল ও শাক-সবজি, সিরিয়াল, ডেয়রী বা দুদ্ধজাত, কার্বনেটেড এবং নন কার্বনেটেড জুস, কোমল পানীয় এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রীর। বাংলাদেশের প্রায় ১৫ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে এখানে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বিপুল অভ্যন্তরীণ বাজার। এই সম্ভাবনা বরং আরো বৃদ্ধি পাবে যদি আমাদের সীমানা সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় ৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলের জনগণের একই ধরণের খাদ্যভ্যাস এবং সংস্কৃতিকে বিবেচনায় রাখা হয়।
যা হোক না কেন, বাংলাদেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পক্ষেত্রে এখনো রয়েছে যথাযথ প্রযূক্তিগত সহায়তার অভাব। এই শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা যদি সহযোগিতা, অংশীদারিত্ব এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে ভড়ৎধিৎফ ধহফ নধপশধিৎফ লিংকেজ স্থাপন করা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং বিকল্প প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বহু ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের উৎপাদন লক্ষ্যনীয়। কেবলমাত্র নতুন পণ্যের উন্নয়নই নয় বরং আধূনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, গুণগতমানের উন্নয়ন, বায়োসেপ্টি এবং প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং সেই সাথে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বিপণন জোরদার করার পাশাপাশি উৎপাদন পদ্ধতির উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কৃষি উৎপাদনের উপরে বহুলাংশে নির্ভরলশীল যেহেতু তার কাঁচামাল মূলত কৃষিজাত পণ্য। এ কারণে এই শিল্পকে নানাবিদ চ্যালেঞ্জ এর মোকাবেলা করতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির উপর নির্ভলশীলতা এবং মৌসূম ভিত্তিক ফসল উৎপাদন। প্রতিবন্ধকতা থাকার সত্বেও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের রয়েছে সর্বাধিক সম্ভবনা। এই সম্ভবনাকে সম্পূর্ন রূপে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন ঝঁংঃধরহবফ ফসল উৎপাদন, মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন এবং জনগনের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশের বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং রপ্তানির ভিত্তিতে নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। লাগসই প্রযুক্তি এবং উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে কৃষি ভিত্তিক শিল্প উন্নয়ন করতে হলে বহুমূখী প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান অনেকগুলো খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এই সেক্টরে যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে এসব থেকে পূর্ণ সুবিধা গ্রহন এবং এই সেক্টরের উন্নয়ন ঘটতে পারে।
বন উপ-খাত
বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে কৃষি থেকেই জীবিকা নির্বাহ করে। ২০১০-১১ অর্থ বছরে শস্য এবং বন উপ-খাত আমাদের জিডিপিতে ১৬.০৩ ভাগ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চল প্রায় ২.১৮ মিলিয়ন হেক্টর, যা দেশের মোট সমতল ভূমির ১৭.০১ ভাগ। সরকারী বনভূমির বেশীর ভাগই বৃক্ষহীন, যার প্রধান কারণ বেপরোয়া বনজ সম্পদ আহরণ (ঊীঢ়ষড়রঃরড়হ)। কেবলমাত্র সরকারী জমির ০.৮৪ মিলিয়ন হেক্টরে (৫.৮ শতাংশ) গ্রহণযোগ্য মাত্রায় বনভূমি রয়েছে। বস্তুত এরিয়া এবং উৎপাদনের বিবেচনায় বাংলাদেশের বনভূমি ক্রমহ্রাসমান। কয়েক দশক আগেও আমাদের বনভুমির ছিল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ, কিন্তু তা এখন কমে ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে। দ্রুতবর্ধনশীল জনগোষ্ঠী, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং মাত্রতিরিক্ত বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহারের কারনে দেশে এখন পাট, টিম্বার, জ্বালানীকাঠ, গোÑখাদ্য (ঋড়ফফবৎ), বাঁশ, বেত, ঔষধীবৃক্ষ ইত্যাদির তীব্র অভাব দেখা দিচ্ছে। কাঠ ভিত্তিক শিল্পকারখানা- যেমন কাগজের কল, নিউজপ্রিন্ট মিল, পাল্প মিল, হার্ডবোর্ড মিল, পারটিকেল বোর্ড মিল, দিয়াশলাই কারখানা, আসবাবপত্র কারখানা, করাতকল ইত্যাদি কাঁচামালের অভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
মানুষ এবং পরিবেশের উপর ভূমি এবং বনজ সম্পদ এর অভাব তীব্র প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় জনগণকে তাদের আদি বনজ সম্পদ থেকে উচ্ছেদ করার কারণে পাহাড়ী অঞ্চলের বনভূমি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বনভূমির সংকোচন ও অনুন্নয়ন এর ফলে বায়োডাইভারসিটি এর উপরেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। সংকুচিত বনভুমির কারণে পাহাড়ী মানুষের আবাস, জীবন জীবিকা এবং সংস্কৃতি ও তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৭৩,০০০ হেক্টর বনভূমি উজার হয়েছে এবং তা কৃষি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে প্রতি বছর প্রায় ৮,০০০ হেক্টর বনভূমি বনশূন্য হয়েছে।
বাংলাদেশের তিনটি পাহাড়ি জেলায় (যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ) প্রচুর পরিমাণে আনারস, কমলালেবু, কলা, পেঁপে, কাঠাল এবং আম ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। কিন্তু বেশীরভাগ পণ্য পচনশীল হওয়াতে এবং যথাযথ বিপণন সুযোগ সুবিধা না থাকায় চাষীরা তাদের পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পায় না। উপরোক্ত ফলফলাদী এবং শাক-সবজি ছাড়াও বহুসংখ্যক চাষীরা পাহাড়ী এলাকায় মূল্যবান মশলাদী যেমন, আদা, হলুদ ইত্যাদি আবাদ করছে যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় এক চর্তুথাংশ পূরণ করছে। এ অঞ্চলের কৃষকেরা মনে করে যে, কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প এবং বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে তারা কৃষিজাত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই উদ্দেশ্যে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদেরকে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের উন্নয়নে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা দেবে। কাজেই পাহাড়ী অঞ্চলের কৃষক এবং জনগণের স্বার্থে ঐ অঞ্চলে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশের কৃষিতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। এ সকল কারণের মধ্যে রয়েছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ, কার্যকর সার ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি ঋণের উন্নত বন্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। ২০১০-২০১১ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল ২৮.৮ মিলিয়ন টন। সে তুলনায় গমের উৎপাদন ছিল ৯ মিলিয়ন টন। কিন্তু উৎপাদন সামর্থের উপরে জনসংখ্যার চাপ ক্রমশঃ বেড়ে চলছে। ফলে খাদ্য ঘাটতি বিশেষত: গমের উপর নির্ভরতা লেগে থাকছে। তা সত্বেও আমাদের কৃষি ব্যবস্থা বহুমূখী সমস্যার মোকাবেলা করে এগিয়ে চলছে। কোথাও কোথাও যেমন- উত্তরাঞ্চলে মৌসূমী খাদ্যাভাব এখনো সমস্যা হিসেবে বিরাজমান।
বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে- কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মনে করছেন আগামী ১২-১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা নিজেদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ফসলের জিনম আবিষ্কার করবে যা দ্বারা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে একই সাথে মানুষের চাহিদা অনুসারে ফসলের গুণগত পরিবর্তন ঘটবে। জিনম আবিষ্কারের অগ্রগতি আমাদেরকে আশাবাদী করে তুলেছে। পাটের জিনম ও ফসলের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকের জিনম আবিষ্কার সেই অগ্রগতিরই চিহ্ন বহন করে। এরই ধারাবাহিকতা হতে লবণসহিষ্ণু জিন আবিষ্কার সম্ভব হলে শুধু বাংলাদেশের কৃষিতে নয়, ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বিশ্ব কৃষিতে।
বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ লবণাক্ত জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এ থেকে যে অতিরিক্ত ফসল ফলবে তার পুরোটাই বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে, যা থেকে দেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। এবং লবণসহিঞ্চু জিনের পেটেন্ট স্বত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ করে সমগ্র বিশ্বের কৃষিতে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে। লবণাক্ততা সহিঞ্চু উন্নত জাত রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক শষ্য ও বীজ দ্বারা বাজার দখল করা সম্ভব হবে। এভাবে অন্যান্য ফসলের জিনম আবিস্কার করে এবং তা যথাপোযুক্ত ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন ও বাজার জাতকরনে আমাদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন ফসলের পেটেন্ট স্বত্ত্ব নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য আমাদের কৃষিতে প্রচুর পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে।
বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষক দেশের তৈরী বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের ফসল ও বীজ উৎপাদনের দক্ষতার পাশাপাশি খরচ কমাতে সক্ষম হবে। প্রতিটি কৃষকের হাতে নিজেদের তৈরী উন্নত জাতের দেশী বীজ থাকবে ফলে বীজ বা প্রযুক্তির জন্য কারো উপর নির্ভর করতে হবে না। বাংলাদেশের কৃষিতে একক বা ক্ষুদ্র কৃষকের স্থলে যৌথ বা সাংগঠনিকভাবে একত্রিত হওয়া বৃহৎ কৃষকের সৃষ্টি হবে। ফলে তারা যৌথভাবে একটি এলাকার কৃষির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে এবং যার অংশীদার হবে তারা নিজেরা। তারা নিজেরাই নিজেদের ফসলের বীজ, উন্নত জাতের মাছের বীজ ও মাছ উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বিক্রি করতে পারবে। তাদের নিজেদের আয় হতে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা তারা নিজেরাই আবার পোল্ট্রি, গবাদি বা দুগ্ধজাত খামার করে নিজেদের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন পুষ্টি চাহিদা মেটাবে অন্য দিকে অতিরিক্ত উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। কৃষকরা দেশে তৈরী পাওয়ার ট্রিলার, ধান মাড়াই যন্ত্র বা দানা ফসল মাড়াই যন্ত্র, আগাছা নাশক যন্ত্র, বীজবপন যন্ত্র, ফসলকাটা ও শ্রেনী বিন্যাসকরণ যন্ত্র, কন্দ বা মূল জাতীয় ফসল মাটি থেকে উত্তোলন যন্ত্র, উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন সেচ যন্ত্র, ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করনের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি শ্রমিকের চাহিদা ও খরচ দুটোই কমাতে সক্ষম হবে। একই সাথে দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে যা দ্বারা অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
পর্যায়ক্রমে কৃষিতে জৈব চাষ পদ্ধতির বিকাশ ঘটবে। যার ফলে আমাদের মাটির গুণগত মান বজায় রাখা ও ভেজালমুক্ত খাবার পরিবেশন করা সম্ভব হবে। এভাবে প্রতিটি গ্রাম থেকে অতিরিক্ত ফসল ও বীজ সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে রপ্তানি করে দেশের মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং শস্য আমদানি বাবদ খরচ কমানো সম্ভব হবে। যৌথভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলো বিক্রির জন্য কৃষকদের দ্বারাই সৃষ্ট বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। এর ফলে কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পাবে এবং ভোক্তারাও ভেজালমুক্ত পণ্যের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও লাভবান হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস পাবে। কৃষিপণ্য পরিবহন সহজতর করার লক্ষ্যে লঞ্চ বা জাহাজের পাশাপাশি কৃষি রেল ব্যবস্থা চালু হবে। ফলে কৃষকরা কম খরচে সহজেই দেশের বিভিন্ন শহর বা বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে। দেশের কৃষি বাজারগুলোতে গতি ফিরে আসবে। কৃষি পণ্য পরিবহনের জন্য কাভার্ডভ্যান, ট্রেন বা জাহাজে চাপ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যুক্ত কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা থাকবে।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য কৃষকবান্ধব কৃষি বীমা চালুর ব্যবস্থা হবে। এবং কৃষি ভর্তুকি বা অন্যন্য কৃষি সহায়ক ব্যবস্থা সহজেই কৃষকের দোরগোড়ায় পৌছে যাবে। কৃষকরা অত্যাবশ্যকীয় নাগরিক সুবিধা ও প্রকৃত রাষ্ট্রীয় সম্মান পাবে। দেশের প্রশিক্ষিত কৃষক ও কৃষিবিদদের দ্বারা দেশের বাইরে জমি লিজ নিয়ে সেখানে চাষাবাদ করে বিশ্বে খাদ্যঘাটতি ও খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যার পদক্ষেপ হিসাবে আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে জমি লিজ নিয়ে সেখানে বীজ ও ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছে। কৃষির এই আমূল পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দেশের সমূদ্রসীমায় লবণাক্ত পানিতে হাইড্রোপনিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক এলাকা চাষের আওতায় এনে অতিরিক্ত ফসল ফলানো সম্ভব হবে। এবং শহরাঞ্চলের বাড়ীর ছাদে ছাদে ফুল, ফল ও সবজি শোভা পাবে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করবে। গ্রামগুলোও একসময় রাস্তার দুপাশ দিয়ে সুবৃহৎ অট্রালিকা আকারে গড়ে উঠবে এবং কৃষিজমির উপর চাপ কমানো সম্ভব হবে। এভাবে বাংলা আবার শস্য শ্যামলে ভরপুর হয়ে তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।
উত্তর সমূহ